১৬. ইমাম হুসাইন ইবনে আহমাদ আদ-দামিগানী হানাফী রহ.[মৃত:৪৭৮ হি:] এর তাফসীর:
ইমাম দামিগানী রহ. তার ইসলাহুল উজুহ কিতাবে লিখেছেন,
الاستواء بمعنى القهر والقدرة، قوله تعالى في سورة طه: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى }، أي قدر وقهر. اهـ
অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও কুদরত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহায় বলেন, "দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ এখানে ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, ক্ষমতা ও কুদরত প্রকাশ করা বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[ইসলাহুল উজুহ, পৃ.২৫৫]
১৭. ইমাম আবুল মায়ালী জুয়াইনী রহ. [মৃত: ৪৭৮ হি:] এর বক্তব্য:
ইমাম জুয়াইনী রহ. তার আল-ইরশাদ কিতাবে লিখেছেন,
فإن استدلوا بظاهر قوله تعالى: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه:5]، فالوجه معارضتهم بآي يساعدوننا على تأويلها، منها قوله تعالى: {وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ} [سورة الحديد: 4] وقوله تعالى: {
أَفَمَنْ هُوَ قَآئِمٌ عَلَى كُلِّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ} [سورة الرعد: 33] فنسائلهم عن معنى ذلك، فإن حملوه على كونه معنا بالإحاطة والعلم، لم يمتنع منا حمل الاستواء على القهر والغلبة، وذلك شائع في اللغة، إذ العرب تقول استوى فلان على الممالك إذا احتوى على مقاليد الملك واستعلى على الرقاب. وفائدة تخصيص العرش بالذكر أنه اعظم المخلوقات في ظن البرية، فنص عليه تنبيها بذكره على ما دونه. ... ثم الاستواء بمعنى الاستقرار بالذات ينبئ عن اضطراب واعوجاج سابق، والتزام ذلك كفر."اهــ
অর্থ: যদি মুজাসসিমারা সূরা ত্বহার ৫ নং আয়াতের বাহ্যিক অর্থ দ্বারা প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বিপরীতে সেসব আয়াত উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো এই আয়াতের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং তারা এগুলোর ব্যাখ্যা করতে বাধ্য। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যেখানেই থাকো আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছেন। [সূরা হাদীদ, আযাত নং ৪]। আল্লাহ তায়ালা সূরা রাযাদ এর ৩৩ নং আয়াতে বলেন, তাদের কর্মসমূহ পর্যবেক্ষণের জন্য আল্লাহ তায়ালা কি প্রত্যেক নফস বা আত্মার উপর দন্ডায়মান নন? আমরা তাদেরকে এসব আয়াতের অর্থ জিজ্ঞাসা করবো। তারা যদি এসব আয়াত দ্বারা রুপক অর্থ নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা ইলম ও পরিবেষ্টন দ্বারা আমাদের সাথে রয়েছেন, তাহলে আমরাও বলবো, ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ হলো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, ক্ষমতা প্রয়োগ করা বা অধীন করা। আরবী ভাষায় এর ব্যবহার রয়েছে। কেননা আরবরা বলে থাকে, استوى فلان على الممالك অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি দেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জনগণকে নিজের অধীন করেছে।
আল্লাহ তায়ালা আরশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এজন্য যে, সৃষ্টির মধ্যে আরশ সবচেযে বড়। এটি উল্লেখ করে তিনি বুঝিয়েছেন, অন্যান্য ছোট সৃষ্টিও তার ক্ষমতার অধীন। ..... ইস্তেওয়া শব্দের অর্থ যদি করা হয়, আল্লাহর সত্ত্বা স্থির হয়েছেন বা স্থান গ্রহণ করেছেন, তাহলে এটি নির্দেশ করে যে, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে অস্থির বা গতিশীল ছিলেন। আর এধরনের অর্থ সুস্পষ্ট কুফুরী।
১৮. বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ আবুল হাসান আলী ইবনে ফাজ্জাল আল-মুজাশায়ী [মৃত: ৪৭৯ হি:] তার আন-নুকাতু ফিল কুরআনিল কারীমে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[আন-নুকাতু ফিল কুরআনিল কারীম, পৃ.১৭৪-১৭৫]
১৯. জগৎ বিখ্যাত আরবী ভাষাবিদ ইমাম রাগেব ইসপাহানী [মৃত: ৫০২ হি:] তার " আল-মুফরাদাত" নামক কিতাবে লিখেছেন,
"ومتى عدّي- أي الاستواء – بـ "على" اقتضى معنى الاستيلاء كقوله: {الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } [سورة طه]"اهــ
অর্থাৎ ইস্তেওয়া শব্দটি যখন 'আলা' অব্যয় সহ ব্যবহৃত হয়, তখন এর অর্থ হয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, " দয়াময় আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। [সূরা ত্ব-হা, আয়াত নং-৫] [আল-মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন, পৃ.২৫১]
২০. ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ আল-মুতাওয়াল্লী [মৃত: ৪৭৮ হি:] তার আল-গুনইয়া নামক কিতাবে ইস্তেওয়ার অর্থ করেছেন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
[আল-গুনিয়া ফি উসুলিদ্দীন, পৃ.৭৮]
২১. ইমাম গাজালী রহ. [মৃত: ৫০৫ হি:] তার বিখ্যাত কিতাব ইহইয়াউ উলুমিদ্দীনে লিখেছেন,
"وليس ذلك إلا بطريق القهر والاستيلاء" اه
"পবিত্র কুরআনের ইস্তেওয়া মূলত: ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থেই গৃহীত হবে"
[ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, ইয়াহইয়াউ উলুমিদ্দীন, খ.১পৃ.১৮৬]
২২. ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী হানাফী রহ. [মৃত: ৫০৮ হি:] তার বিখ্যাত কিতাব " তাবসিরাতুল আদিল্যা"-তে লিখেছেন,
"فعلى هذا يحتمل أن يكون المراد منه: استولى على العرش الذي هو أعظم المخلوقات وتخصيصه بالذكر كان تشريفا له"، ثم قال: وتزييف (بعض) الأشعرية هذا التأويل لمكان أن الاستيلاء يكون بعد الضعف. وهذا لا يتصور في الله تعالى، ونسبتهم هذا التأويل إلى المعتزلة ليس بشىء، لأن أصحابنا أولوا هذا التأويل ولم تختص به المعتزلة. وكون الاستيلاء إن كان في الشاهد عقيب الضعف ولكن لم يكن هذا عبارة عن استيلاء عن ضعف في اللغة، بل ذلك يثبت على وفاق العادة كما يقال علم فلان، وكان ذلك في المخلوقين بعد الجهل، ويقال قدر، وكان ذلك بعد العجز، وهذا الاطلاق جائز في الله تعالى على إرادة تحقق العلم والقدرة بدون سابقة الجهل والعجز، فكذا هذا. "اهــ.
" ইস্তেওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ারা আরশের উপর নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরশ আল্লাহর সবচেয়ে বড় মাখলুক। আরশকে বিশেষভাবে উল্লেখের ফায়দা হলো, আরশের বড়ত্ব প্রকাশ করা। কিছু কিছু আশআরী ইস্তেওয়ার এই ব্যাখ্যাকে এভাবে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে যে, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বারা তো বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে দুর্বল বা কর্তৃত্বহীন ছিলেন। অথচ আল্লাহর ক্ষেত্রে এটি কল্পনাও করা যায় না। কেউ কেউ এ ব্যাখ্যাকে মু'তাজিলাদের দিকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছে। কেননা বহু আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরাম এই ব্যাখ্যা করেছেন। এটি শুধু মু'তাজিলাদের ব্যাখ্যা নয়। বাহ্যদৃষ্টিতে আমরা কর্তৃত্বহীন ব্যক্তিকে কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে দেখি। কিন্তু আরবী ভাষা কখনও এটি বোঝায় না। বরং এটি সৃষ্টির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ঘটে থাকে। যেমন বলা হয়, অমুক জ্ঞানী হয়েছে। মাখলুকের ক্ষেত্রে পূর্বে মূর্খ থাকলেই কেবল বলা হয় সে জ্ঞান অর্জন করেছে। আমরা বলে থাকি, সে শক্তিশালী হয়েছে। মাখলুক ক্ষমতাহীন অবস্থা থেকে ক্ষমতা অর্জন করলেই কেবল এটা বলা হয়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে ইলম ও কুদরত শব্দ এই শর্তে ব্যবহার করা জায়ে যে, আল্লাহর ক্ষেত্রে পূর্বে অক্ষমতা বা মূর্খতার কল্পনাও করা যাবে ন। একইভাবে ইস্তেওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। "
[তাবসিরাতুল আদিল্লাহ, খ.১, পৃ.২৪২]
[চলবে......]
No comments:
Post a Comment